প্রাইভেট ব্যাচ নাকি জেনারেল ক্লাস? সমাধান কোন পথে?
সেদিন ছিল জুলাই মাসের এক তারিখ।
ক্লাসে ঢুকেই থতমত খেলো রতন। কানায় কানায় ভরে গেছে মাঝারি সাইজের ক্লাসরুমটি। কিছু শিক্ষার্থী বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে জায়গা নেই আর। মাইক্রোফোন হাতে শিক্ষকটিকে ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে।
মাঝে মাঝে অসহায় শিক্ষকটি হাতে থাকা ডাস্টার দিয়ে টেবিলে আঘাত করছেন। মুহূর্তের নীরবতা। তারপর আবার গুঞ্জন, কোলাহল, চেচামেচি। সর্বোচ্চ পাঁচজন বসা যাবে এমন একটা বেঞ্চে রতনরা বসেছে সাতজন। সে-কি চাপাচাপি!
রতন দেখতে পেল, তিন বেঞ্চ সামনের ছাত্রছাত্রীরা আরামে ফেসবুক চালাচ্ছে। একদম পেছনের ডান কোনায় চারজন ছাত্র গোল হয়ে আড্ডা মারছে। রতনের পাশের জন ঝিমোচ্ছে, ঘুমোবে বোধহয়। অসহায় শিক্ষক যার পরিচয় এখনো জানে না রতন, তিনি ভাষণ দিয়েই যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে ডাস্টার দিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছেন টেবিলটাকে।
বাড়ি ফেরার পরেও ক্লাসের গুনগুন ধ্বনি কানে বাজতে থাকলো রতনের।
পরেরদিন একই চিত্র।
তারপরের দিনও তাই।
ইদানীং তাই রতন ক্লাসের বাইরেই ঘোরাফেরা করে।
ভেতরে ঢোকার সাহস পায় না সে।
এত শব্দ দূষণ!
সেদিন বাংলা ক্লাস চলছিল।
রতন ক্লাসের বাইরে নতুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছিল। ওদেরকে দেখে ডেকে নিলো এক শিক্ষক। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "এই বাচ্চারা, তোমরা তো নতুন ভর্তি হয়েছো। কিন্তু, ক্লাস করো না কেন?"
রতন সাহস করে উত্তর দিলো, "ক্লাসে বসার জায়গা পাই না স্যার। বসতে পারলেও, লাভ নেই। এত স্টুডেন্টস ক্লাসে যে কিচ্ছু শোনা যায় না। বোঝা যায় না।"
শিক্ষক বললেন, "শোনো বাচ্চারা, ক্লাসে আসবা জাস্ট বিনোদনের জন্য। ওখানে বোঝার চেষ্টা করে লাভ নেই। বুঝতে গেলে ভিন্ন ওয়ে ফলো করতে হবে।"
"কী ওয়ে স্যার?", জিজ্ঞেস করলো রতন।
শিক্ষক বললেন, "প্রাইভেট ব্যাচে আসতে হবে। যারা এ পর্যন্ত ভালো রেজাল্ট করেছে, তাঁরা প্রাইভেট পড়েই করেছে। প্রাইভেটে ইন করো। আর কলেজে এসে মজা লুটো।"
রতন অবাক না হয়ে পারলো না। শিক্ষক হয়ে এমন বিজ্ঞাপন!
"স্যার, আপনার নামটা কি একটু জানা যাবে?"
হাসি দিলেন শিক্ষকটি। তারপর বললেন, "আমার আসল নাম বললে চিনতে কষ্ট হবে তোমাদের। ছাত্র ছাত্রীরা আমাকে চেনে জনপ্রিয় স্যার হিসেবে। শুধু বলবা জনপ্রিয় স্যারের বাসা কোনটা? সবাই চিনিয়ে দেবে?"
কয়েকদিন পর।
সকাল আটটায় জনপ্রিয় স্যারের বাসায় নতুন ছাত্র হিসেবে প্রাইভেট পড়তে আসলো রতন। দরজার সামনে গিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। বাইরে থেকে গুনে দেখে ক্লাসের ভেতরে পঞ্চান্ন জন ছাত্রছাত্রী। মনে মনে ভাবতে থাকে রতন, "এটা কি জেনারেল ক্লাস? নাকি প্রাইভেট ব্যাচ? কলেজের গ্রুপের ক্লাসগুলোতে এত স্টুডেন্টস উপস্থিত থাকে না!"
রতনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জনপ্রিয় স্যার ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, "কি ব্যাপার রতন, বাইরে দাড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো। প্রাইভেট তো শুরু হয়ে গেছে।"
"সরি স্যার, বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম- জেনারেল ক্লাস চলছে। যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি স্যার?"
"কেন নয়? অবশ্যই পারো। বলো।"
"এক ব্যাচে কতজন পড়ান স্যার?"
"মিনিমাম চল্লিশ জন। সর্বোচ্চ যত জন পড়ানো যায়। আসলে কি জানো রতন, প্রাইভেট হলো ব্যাবসা। আর ব্যাবসা মানেই মুনাফা। মুনাফা মানেই কৌশল। কৌশলে যত বেশি স্টুডেন্টস পড়ানো যায় ততই মুনাফা। যে টিচার এক ব্যাচে যত বেশি স্টুডেন্টস পড়ায়, তার জনপ্রিয়তাও তত বেশি। যেমন আমার। ভাবছি- প্রাইভেট ব্যাচে মাইকের ব্যাবস্থা করবো। কিছুদিন পর লাগাবো প্রোজেক্টর। ডোন্ট ওরি, এসিও থাকবে সেখানে।"
এতটুকু শুনে বেহুশ হয়ে পড়ে গেল রতন।
তারপরেও ছাপ্পান্নতম ছাত্র হিসেবে সেই ব্যাচে ইন করেছিল সে।
কিন্তু কেন???
কারণটা সচেতন মহলের অজানা নয়।
ওয়াদুদ খান
সদরপুর, ফরিদপুর
০১৭৮৫-৫৬২০৮০
তারিখ: ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন